মোহাম্মদ মহিনউদ্দীন রাজু
বৈশাখের পড়ন্ত বিকেল। পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে সূর্যটা। শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের উপর, রক্তিম সূর্যের লালচে আলোর মাখামাখি সেখানে। ক্যাম্পাসটা ঠিক আগের মতই আছে। বরং বৈশাখে কয়েকবার বৃষ্টি হওয়াতে চারিদিকটা আরও সবুজ হয়ে উঠেছে, হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী।
অন্য সময়টাতে এই রমজান মাসে ইফতারের আগে চারিদিকে লোকে-লোকারণ্য থাকতো। টিএসসির সবুজ ঘাসের উপরে চলে বন্ধু-বান্ধব সহপাঠী মিলে ইফতারির আয়োজন। অপরাজেয় বাংলা, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, হাকিম চত্বর, কার্জন হলের সবুজ চত্বর, শহীদ মিনারের বেদী, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সর্বত্র থাকে ছাত্র-ছাত্রীদের ইফতার আয়োজনের ব্যস্ততায় মুখর। ইফতারের সাথে সাথে চলে খুনসুটি, হই-হুল্লোড় আর আগামীদিনের সোনালী স্বপ্নের পরিকল্পনা।
বাদ যান না প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও। তারাও দল বেধে ক্যাম্পাসে আসেন সবাই মিলে একসাথে বসে ইফতার করার জন্য। গল্পে গল্পে ফিরে যান ছাত্র জীবনের মধুর সময়টাতে, এ যেন শুধু ইফতারির আয়োজন নয় প্রাণের সাথে প্রাণের মিলনের এক সেতুবন্ধন।
কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এবার চিত্রটা সম্পূর্ণ আলাদা। চারিদিকে শুনশান নিরবতা, ডাসের সামনে কিছু ছিন্নমূল মানুষের জটলা। ওরা সারাদিন এদিকটাতে থাকে কিছু খাবার প্রাপ্তির আশায়। আমার মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগে আমাদের দেশের কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা আন্দোলনের কথা। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কার্যকলাপে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওরা নিজেরা অসংগতিগুলো চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের, সাথে নির্দেশ করে প্রতিকারের পথও। ওদের আন্দোলনের একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল “রাষ্ট্রের মেরামত কাজ চলছে সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত”।
বর্তমান পৃথিবীতে চলছে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের জয়জয়কার। জয় দেখিয়ে নয় বরং ভয় দেখিয়ে চলছে রাষ্ট্রনেতাদের রাষ্ট্রশাসনের অভিশ্রান্ত অপচেষ্টা। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ লুট এবং বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য চলছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর অমানবিক প্রক্সিযুদ্ধ।
বিশ্ব বিবেক হচ্ছে প্রতিনিয়ত অবদমিত, রক্তাক্ত হচ্ছে মানবতা। প্রকৃতি হয়তো এত অত্যাচার আর সইতে পারছে না, তাইতো আমাদের মানব সভ্যতাকে অসহায় করে করোনাভাইরাস জানান দিচ্ছে, প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধকে। করোনার আক্রমণ হতে রক্ষা পাচ্ছে না ধনী-দরিদ্র, সহায়-অসহায়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কোনো মানুষ। করোনাভাইরাস সবাইকে একসাথে মৃত্যুর ভয়ে চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই অসহায়। হয়তো পৃথিবী নামক গ্রহটায় সৃষ্টিকর্তা আমাদের বার্তা দিচ্ছে, মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেককে আবারও একবার মূল্যায়নের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার। এখনই সময় মানবতা নামক শিক্ষাটাকে অর্জন করে আগামীর পৃথিবীটাকে সুন্দর করে তোলার। একমাত্র জাতীয় ঐক্য এবং বিশ্ব সংহতিই পারে আমাদের এই কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা করতে। উদয় হোক আমাদের শুভ বোধশক্তির, জয় হোক মানবতার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আযানের ধ্বনি। চিন্তার কাল্পনিক জগত থেকে ফিরে আসি বাস্তবতার আঙিনায়। হাতে থাকা পানির বোতলটাতে চুমুক দিয়ে ইফতারি করি, আর মনে মনে ভাবতে থাকি ইনশাআল্লাহ অচিরেই করোনার কাল কেটে যাবে এবং আবারও ক্যাম্পাস মুখরিত হয়ে উঠবে আমাদের মেধাবী ছেলে-মেয়েদের পদচারণায়। ওদের শাণিত মেধার সাথে মানবিকতা যুক্ত হয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে। বিশ্ব মানব সভ্যতা ফিরে পাবে আবার চিরচেনা সেই প্রাণচাঞ্চল্য। আগামী বছর সবার সাথে ইফতারির শুপ্তকামনা নিয়ে আনমনে পা বাড়ালাম মসজিদের দিকে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
স্বপ্নচাষ/আরএস
বাংলাদেশ সময়: ১২:১৯ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ১১ মে ২০২০
swapnochash24.com | sopnochas24