• শনিবার ২৫শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ ১১ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ

    শিরোনাম

    স্বপ্নচাষ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন  

    নিরাপদ সবজি গ্রাম গড়ে বঙ্গবন্ধু কৃষি স্বর্ণপদক জয়

    স্বপ্নচাষ ডেস্ক

    ১১ নভেম্বর ২০২২ ১১:৩২ অপরাহ্ণ

    প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে জনজীবন যখন স্থবির তখন মুজিব বর্ষের উপহার হিসেবে নিজের কর্মস্থল রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে নিরাপদ সবজি গ্রাম গড়ে পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। করোনার প্রকোপে মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পাওয়ায় বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষে গৃহিণীদের উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করেন তিনি। প্রথমে গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের কালীদীঘী গ্রামকে বেঁছে নিলেও পরে আরও দুইটি গ্রামে তার প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি চাষে বিপ্লব ঘটে। ফলে মুজিব বর্ষের চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়ে সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় নানাভাবে প্রশংসিত হন তৎকালীন গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। কৃষিক্ষেত্রে এসব অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদক পেয়েছেন এই কৃষি কর্মকর্তা। বর্তমানে পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

    কৃষিক্ষেত্রে যেসব অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বর্ণপদক :

    কৃষকদের জীবন-মান উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাওয়া তৎকালীন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম মুজিববর্ষে ব্যতিক্রমী কিছু করার চিন্তা করেন। যেই চিন্তা সেই কাজ। করোনাকালে ঘরবন্দি গোদাগাড়ীর কালীদীঘী গ্রামের ৫০টি পরিবারের মাঝে বিনামূল্যে পালং শাক, লাল শাক, বেগুন, মরিচ, ফুলকপি, বাধাকপি, পটল, টমেটো, বেগুন, তরমুজসহ কয়েকটি সবজির বীজ বিতরণ করেন। এগুলো বাড়ির আনাচে-কানাচে বোপণ করে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়াই চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। এক্ষেত্রে পোকা দমনে শুধু জৈব বালাইনাশক, সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ও হলুদ স্টিকি ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। কিটনাশক ব্যবহার ছাড়াই বাম্পার ফলন হওয়ায় পুরো গ্রামেই নিরাপদ এই সবজি চাষ শুরু হয়। এতে কালীদীঘী গ্রামটি নিরাপদ সবজি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পায়।

    এই গ্রামের সবজি বিপ্লবের খবর ছড়িয়ে পড়লে পাশের চব্বিশ নগর ও দেওপাড়া গ্রামেও শুরু হয় সবজি চাষ। সেখানেও সরকারি তহবিল থেকে একটি টাকাও খরচ না করে নিজ খরচে বাড়িতে বাড়িতে নিরাপদ সবজি চাষে সহায়তা ও উদ্বুদ্ধ করেন কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। এখন অন্য গ্রামের কৃষকরাও এটা অনুসরণ করছেন। কৃষিক্ষেত্রে এসব অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদক পেয়েছেন কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম।

    স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিরাপদ সবজি গ্রাম প্রতিষ্ঠায় ধাপে ধাপে ১০ হাজার কৃষককে প্রশিক্ষিত করেছেন কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। এক্ষেত্রে তিনি অসংখ্য উঠান বৈঠক, মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

    তবে কোনো পুরস্কারের আশায় নয়, বরং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই কৃষিতে বিপ্লব ও কৃষকের জীবন-মান উন্নয়নে ২০১৫ সাল থেকেই বিভিন্ন কাজ শুরু করেন বলে জানান কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, নিরাপদ সবজি গ্রাম প্রতিষ্ঠার আগে ২০১৫ সালে নিজের তৎকালীন কর্মস্থল তানোরে অফিস শেষ করে বিকেল ৫টার পর তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সমস্যা চিহ্নিত করে সহায়তা করেন।

    বাদামি গাছ ফড়িংয়ের আক্রামণ ঠেকিয়ে কৃষকের মুখে হাসি :

    ২০১৫ সালে ধান ক্ষেতে বাদামি গাছ ফড়িং (ফুতুকি/কারেন্ট) পোকার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েন রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষকরা। পোকাটি গাছের রস শুষে গোড়া কেটে দেয়ায় ধান পাকার আগেই গাছের আগা মরে যাচ্ছিল। ফলে অনেক সময় এগুলো আগুনে জ্বালিয়ে ফেলতে হতো। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তেন কৃষকরা। এই সমস্যার সমাধানে কাজ করতে চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিরুৎসাহিত করেন। এতে বিষয়টিকে আরও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে অফিস শেষে কৃষকদের নিয়ে কাজ শুরু করলে সফলতা আসতে শুরু করে।

    এভাবেই নিজের চ্যালেঞ্জ জয়ের বর্ণনা দেন সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, গাছ ফড়িং নির্মূল করে ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকদের সঙ্গে একের পর এক মিটিংয়ে অংশ নিয়ে মোটিভেশন ও সহায়তা দেয়া হয়। এছাড়া পার্চিং পদ্ধতি চালু করায় আরও দ্রুত সফলতা আসে। ফসলের জমিতে গাছের মরা ডাল, কঞ্চি বা বাঁশের আগা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করার নাম ‘পার্চিং’। পার্চিংয়ে পাখি বসার সুযোগ পেলে ক্ষতিকর ধরে খেয়ে ফেলে। এভাবে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ধানক্ষেতের পোকার আক্রমণ কমিয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায়। এতে গাছ ফড়িংয়ের উপদ্রপ কমে যাওয়ায় মাঠে মাঠে দোল খাওয়া শুরু করে ধান। এতে কাজের প্রতি আরও গতি বেড়ে যায় তরুণ কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের। ফলে আরও উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি।

    পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন:

    বরেন্দ্র অঞ্চলে ক্রমেই নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। ফলে এই অঞ্চলে হস্তচালিত নলকূপ তো দূরের কথা গভীর নলকূলেও পানি ঠিকমতো উঠে না। তাই ২০১৯ সালে গোদাগাড়ী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েই এই অঞ্চলে ধানের পরিবর্তে পানিসাশ্রয়ী ফসল উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। এর প্রেক্ষিতে ফুলকপি, বাধাকপি, পটল, টমেটো, বেগুন, তরমুজ, ড্রাগন ও মাল্টা চাষ শুরু করেন কৃষকরা। এখানেও বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি চাষ করে কৃষকের ভাগ্য বদলে যায়। এখানেও তিনি রাসায়নিক কিটনাশকের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একটি জমিতে বারবার রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে মাটির অম্লতা নষ্ট হয়। পানি ধারণক্ষমতা কমে অনুজৈবিক কার্যাবলী ব্যাহত হয়। এতে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা দিনদিন কমে যায়। সে কারণে জৈব এবং প্রাণিজ সার ব্যবহারের জন্য পরামর্শসহ বিশেষায়িত উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে চেষ্টা করা হয়। এতে সফলতাও পান চাষিরা।

    পানি সাশ্রয়ী ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি ভার্মি কম্পোস্টেও কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন তরুণ এই কৃষি কর্মকর্তা। ভার্মিকম্পোস্ট হচ্ছে এক প্রকার জৈব সার যা কেঁচো কম্পোস্ট নামেও পরিচিত। কেঁচো উদ্ভিদ অথবা প্রাণিজ বর্জ্য, বাসী গোবর ইত্যাদি খেয়ে মল ত্যাগ করে এবং মলের সাথে কেঁচোর দেহ থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থও মিশ্রিত হয়। এই ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারে ফসলের বাম্পার ফলন হয়। এক্ষেত্রেও এই কৃষি কর্মকর্তার প্রচেষ্টায় গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষকরা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

    কৃষিকে স্মার্ট বাণিজ্যে রূপ দিতে চান কর্মকর্তা শফিকুল:

    বর্তমানে পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত শফিকুল ইসলাম বলেন, মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে ব্যতিক্রমী কিছু করার ভাবনায় করোনায় ঘরবন্দি অসহায় কৃষক-কৃষাণীদের নিয়ে পারিবারিক সবজি পুষ্টি পূরণে কাজ শুরু করি। নিরলস প্রচেষ্টায় মোটিভেশন ও সহায়তা দিয়ে কৃষকদের সচেতন করতে সক্ষম হই। ৫০টি পরিবারকে নিয়ে শুরু করলেও একে একে তিনটি গ্রাম নিরাপদ সবজি চাষে সাবলম্বী হয়ে উঠেছে। এতে ওই গ্রামগুলো নিরাপদ সবজি গ্রাম হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। এরই স্বীকৃতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২৬ পেয়েছি।

    যদিও কোনো কিছুর আশায় এসব না করলেও পুরস্কার কাজের প্রতি আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, ২০১৫ সাল থেকে কৃষকদের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে কৃষিকে স্মার্ট বাণিজ্যে পরিণত করতে কাজ করে যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে শিক্ষিত ও বেকার যুবকদের কৃষিতে বেশি বেশি অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। কেননা, প্রযুক্তি গ্রহণে আগ্রহী শিক্ষিতরা আসলেই তারা কৃষিকে ব্যবসা হিসেবে নেবে। তারা পরিচ্ছন্ন, সুন্দর, সমন্বিত খামার স্থাপন করলে সেখানে আরও বেশ কিছু বেকারের কর্মসংস্থান হবে। তখন এই কৃষি বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিণত হবে। তখন ওই যুবক নিজেকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। এতে তিনি গর্ববোধও করবেন।

    উল্লেখ্য, গত ১২ অক্টোবর কৃষি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২৫ ও ১৪২৬ প্রদান করা হয়। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার ক্যাটাগরিতে ১৪২৬ বঙ্গাব্দের জন্য স্বর্ণপদক পেয়েছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। এদিন তাকে সনদপত্র, স্বর্ণপদক ও এক লাখ টাকা পুরস্কৃত করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন।

    স্বপ্নচাষ/এসএস

    Facebook Comments Box
    স্বপ্নচাষ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন  

    বাংলাদেশ সময়: ১১:৩২ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১১ নভেম্বর ২০২২

    swapnochash24.com |

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
     
    ১০
    ১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
    ১৮১৯২০২১২২২৩২৪
    ২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
    advertisement

    সম্পাদক : এনায়েত করিম

    প্রধান কার্যালয় : ৫৩০ (২য় তলা), দড়িখরবোনা, উপশহর মোড়, রাজশাহী-৬২০২
    ফোন : ০১৫৫৮১৪৫৫২৪ email : sopnochas24@gmail.com

    ©- 2023 স্বপ্নচাষ.কম কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত।