রাজশাহী অঞ্চলে শুরু হয়েছে চলতি মৌসুমের বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের উৎসব। বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত এই জেলায় এবার ঝড়ঝাপটা তেমন না থাকায় আগেই ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। পাশাপাশি জেলার ৯টি উপজেলাতেই আগাম জাতের এই বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় খুশি তারা। তবে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়ায় বাম্পার ফলনের আনন্দ বিলিন হয়ে যাচ্ছে চাষীদের। অতিরিক্ত অর্থ দিয়েও শ্রমিক না মেলায় বিপাকে পড়েছেন তারা।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, রাজশাহী জেলায় এবার বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিলো ৬৫ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি। তবে তা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে ৬৮ হাজার ৬০০ হেক্টর। যা লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ৩০০ হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে। শুধু তাই নয়, জেলার সব উপজেলায় এবার বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। সেই ধান পেকে সোনালী রঙে শোভা ছড়িয়ে দুলছে জমিতে। এতে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নতুন ধান ঘরে তুলতে মাঠে মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষীরা।
জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহীতে এবার শুরুতে বোরো ধান রোপণে আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় বাম্পার ফলন হয়েছে। আগাম জাতের এই বোরো ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। এ বছর বোরো জমিতে প্রতি বিঘায় সর্বনিম্ন ৩০ থেকে ৩৫ মন করে ফলন হচ্ছে। বাজারে দামও ভালো থাকায় ব্যাপক খুশি চাষীরা। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে ধান লাগানো থেকে কাটা-মাড়াইয়ের বেশিরভাগ শ্রমিকই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। গত কয়েকবছর ধরে তারা শহরে গিয়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। ফলে গ্রামে ধান কাটার শ্রমিক সংকট দেখা দিচ্ছে।
গোদাগাড়ী উপজেলার বিশরাপাড়া গ্রামের মিকাইল হাঁসদা ও তাঁর স্ত্রী পুলসুরি মুর্মু বলেন, দুইজন মিলে ধান কেটেও কিস্তির টাকা হয় না। কিন্তু শহরে কাজে যেতে ১০০ টাকা খরচ হলেও ৫০০-৬০০ টাকা থাকে। এ দিয়ে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিয়েও সংসার ভালই চলে। তাই ধান কাটার চেয়ে শহরের কাজের টাকায় চাল কিনছি। এতেই বেশি লাভ আছি।’
কয়েকবছর ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শ্রমিকেরা দলে দলে এসে রাজশাহীর মাঠে মাঠে ধান কাটেন। এবার এখন পর্যন্ত তারাও আসেননি। ফলে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিয়েও ধান কাটা ও মাড়াইয়ের শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ভালো ফলন হয়েছে। এখন বোরো ধান কাটার মৌসুম। কিন্তু শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় যারা আছেন তারা পারিশ্রমিক হাকাচ্ছেন বেশি। আগে ছয়-সাতজন শ্রমিক এক বিঘা ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ করে দিলে প্রায় আড়াই মন ধান দিতে হতো। এবার সাড়ে চার মণ ধান চাচ্ছেন, তবুও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ধানের বদলে টাকা দিলে একজন শ্রমিককে এখন এক বেলার জন্যই দিতে হচ্ছে ৪০০-৪৫০ টাকা। গতবছর শ্রমিকের এই পারিশ্রমিক কম ছিল।
এছাড়া ঈদের আগের তাপদাহের কারণে জমিতে বেশি পরিমাণ সেচ দিতে হয়েছে। এতে আগেও অনেক খরচ হয়ে গেছে। জেলার বেশ কিছু এলাকায় শিলা বৃষ্টিতে ধানের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বোরো ধানের বাম্পার ফলনের আনন্দ শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষকের মুখ থেকে বিলিন হয়ে যাচ্ছে।
কৃষকরা আরও জানান, সকল প্রকার সারের দাম বস্তাপ্রতি ২৫০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় ধানের আবাদের খরচ বেড়ে গেছে এবার। তবে ধানের দাম ভালো পেলে কৃষকরা লাভবান হবেন। বর্তমানে বাজারে ধানের যে দাম তা নিয়ে খুশি নন কৃষকরা।
গোদাগাড়ী উপজেলার মনিরুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, মিলন হোসেনসহ কয়েকজন কৃষক বলেন, সময়মতো সেচের পানি পাওয়ায় ও আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার ধানের ব্যাপক ফলন হয়েছে। আবহাওয়া এরকম থাকলে অল্প সময়ের মধ্যে আমরা কৃষকরা ফসল ঘরে তুলতে পারবো। তবে শ্রমিক সংকটের কারণে বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
তারা আরও বলেন, ‘এবার ব্রি-২৮ ও জিরাশাইল জাতের ধান আবাদ করতে বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে সাত থেকে আট হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি ধানের ফলন ২৬-৩০ মন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে ধানের যে দাম তা থাকলে তেমন লাভ হবে না। এছাড়া শেষ পর্যন্ত শ্রমিক পাওয়া না গেলে ক্ষতি হয়ে যাবে।’
উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের বিজয় নগর এলাকার কৃষক মামুন হোসেন জানান, ব্রি-৮৮ জাতের ধান ৭ বিঘা জমিতে লাগিয়েছি। বিঘাপ্রতি খরচ নয় থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা। বর্তমানে ধানের বাজার মূল্য মন প্রতি ১২০০ টাকা।
দাম নিয়ে অসন্তুষ্ট প্রকাশ করে তিনি বলেন, আগে আমন ধানের দাম ১৩০০ টাকা মন আমরা পেয়েছি। বোরো ধানের আবাদে খরচ বেশি। তাই দাম ১২০০ টাকা মন যদি হয় তাহলে আমাদের চলবে না। এ ছাড়াও সারের দাম হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়াতে আবাদে খরচ বেড়ে গেছে। এখন শ্রমিক সংকটের কারণেও অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোজদার হোসেন বলেন, রাজশাহী জেলায় এবার বোরো ধান আবাদের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা ছাড়িয়ে গেছে। ধানের ফলনও বেশ ভালোই হচ্ছে। ইতোমধ্যে রাজশাহী জেলায় বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। ধান কাটার আগের মুহুর্তে ধানের জমিতে সেচের জন্য কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। প্রচন্ড তাপদাহের কারণে জমিতে পানি বেশি লেগেছে। ডিপটিউবওয়েলগুলোতে পানি কম উঠায় কৃষকরা সমস্যায় পড়েছেন। তবে ধানের ফলন বেশ ভালোই হয়েছে। আশা করা যায় কৃষকরা যথাসময়ে তাদের ফসল ঘরে তুলতে পারবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘কেবল ধান কাটা শুরু হয়েছে। এখনই শ্রমিক সংকট বলা যাবে না। কারণ, রাজশাহীর ধান কাটেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শ্রমিকেরা। তাঁরা এখনও আসেননি। এক বিঘা ধান কেটে তো তাঁরা বসে থাকবেন না। সব জমির ধান পাকলে ওই শ্রমিকেরা আসবেন। তখন সংকট বোঝা যাবে না।’
এদিকে, রাজশাহীতে কালবৈশাখী ঝরের সঙ্গে শিলা বৃষ্টির আশঙ্কা থাকায় দ্রুত ধান কেটে ঘরে উঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা উম্মে ছালমা। তিনি বলেন, ৮০ শতাংশ ধান পেকে গেলেই বিলম্ব না করে বৈরী আবহাওয়া শুরু হওয়ার আগেই কেটে ফেলতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে কৃষকরা ধান কাটা ও মারাইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে।
স্বপ্নচাষ/একে
বাংলাদেশ সময়: ১:৩০ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৬ মে ২০২৩
swapnochash24.com | sopnochas24
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | |||||
৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ |
১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ |
১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ |
২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ |