করোনাভাইরাসের প্রভাবে ৩০০ কোটি টাকার লোকসানে পড়েছেন সিরাজগঞ্জের তাঁত ব্যবসায়ীরা। বৈশাখ থেকে শুরু করে ঈদ পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা। এ কারণে তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত মালিক ও শ্রমিকরা বিপাকে পড়েছে। করোনার প্রভাবে জেলার প্রায় সব তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আর বেকার হয়ে পড়েছে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় নয় লাখ নারী-পুরুষ।
এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যাংকের ঋণের সুদ মওকুফসহ প্রণোদনা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁত মালিকরা।
তাঁত মালিকরা জানান, জেলার বেলকুচি, কামারখন্দ, এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, কাজীপুর ও সদর উপজেলায় তিন লাখ পাওয়ার লুম ও হ্যান্ডলুম তাঁত রয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় নয় লাখেরও বেশি শ্রমিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এখানকার উৎপাদিত শাড়ি-লুঙ্গি ও গামছা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে তাঁত সমৃদ্ধ এই এলাকা।
প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ ও দুই ঈদ সামনে রেখে শুরু হয় তাঁতপণ্য উৎপাদনের মৌসুম। কিন্তু করোনাভাইরাস নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সিরাজগঞ্জে তাঁত শিল্পের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। শুধু পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জেলায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার তাঁতপণ্য উৎপাদিত হতো। কিন্তু এ বছর তাঁত কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদনও বন্ধ থাকে। এ কারণে তাঁত মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্য মতে, দেশের অন্যতম তাঁত অধ্যুষিত এলাকা সিরাজগঞ্জ জেলা। এ জেলায় তাঁত বস্ত্র উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত সুপরিচিত। সিরাজগঞ্জ জেলার সঙ্গে তাঁতের নাম অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। এ জেলায় তাঁতি পরিবারের সংখ্যা ১৪ হাজার ৮৭০ এবং তাঁত সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৩৫ হাজারের অধিক। প্রতি বছর এ জেলায় হস্তচালিত তাঁত থেকে প্রায় ২৩ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া এ শিল্পের সঙ্গে তিন লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জেলার কয়েকটি হাটে তাঁতিদের উৎপাদিত বস্ত্র বিক্রি হয়ে থাকে। যার মধ্যে সোহাগপুর হাট, এনায়েতপুর হাট, শাহজাদপুর হাট ও বেলকুচির হাট উল্লেখযোগ্য।
জেলার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, সদর, কামারখন্দ, বেলকুচি, রায়গঞ্জ, চৌহালী, কাজিপুরে তাঁত কারখানা রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি হয়। বিশেষ করে উল্লাপাড়া, বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, পাঁচলিয়া বাজারে সাপ্তাহে দুদিন বিশাল কাপড়ের হাট বসে। এসব হাটে লাখ লাখ টাকার কাপড় বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আসে এসব হাটে। এমনকি সিরাজগঞ্জের উৎপাদিত কাপড় বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম ও পাওয়ার লুম অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক হাজি বদি-উজ্জামান বলেন, ‘সিরাজগঞ্জে প্রায় তিন লাখ তাঁত রয়েছে (হ্যান্ডলুম ও পাওয়ার লুম)। এখানকার উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। জেলার এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে নয় থেকে ১০ লাখ মালিক, শ্রমিক, কর্মচারী। করোনাভাইরাসের কারণে জেলার সব তাঁত কারাখানা বন্ধ রয়েছে। বেকার হয়ে পড়েছে লাখ লাখ শ্রমিক। বৈশাখ থেকে শুরু করে ঈদ পর্যন্ত তাঁত শিল্পে ক্ষতি হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যাংকের ঋণের সুদ মওকুফসহ প্রণোদনা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘তাঁত বোর্ড থেকে প্রান্তিক তাঁতিদের (১ থেকে ২০টি তাঁত) জন্য আর্থিক সহযোগিতা করা হলেও অধিক তাঁত যাদের রয়েছে তাদের কোনো সহযোগিতা করা হয় না। এ ব্যাপারে আমরা তাঁত বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।’
কামারখন্দ উপজেলার চরদোগাছী গ্রামের আমজাদ হোসেন বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতর। বছরে এই দুই উৎসবে তাঁতের শাড়ির জমজমাট ব্যবসা হয়। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে বাংলা নববর্ষ ও ঈদে কোনো ব্যবসা করতে পারিনি। এ কারণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে তাঁত ব্যবসায়ীরা। শ্রমিকদের দাবি, তাদের কাজ করার অনুমতি দেওয়া হোক। অন্যথায় তাদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হোক।’
সদর উপজেলার একজন কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, ‘তাঁতের ব্যবসা নাই। রমজান মাসে ব্যবসায়ীরা আশায় করে থাকে ভালো ব্যবসা হবে। কিন্তু করোনাভাইরাস তাঁতিদের সেই স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে। শুরু ব্যবসায়ীরা না। এর সঙ্গে শ্রমিক কর্মচারীরাও বিপদে পড়েছে। সামনে হালখাতা ও কিস্তি রয়েছে। কীভাবে শোধ করব, তা নিয়ে চিন্তাই আছি।’
বেলকুচি উপজেলার তাঁত শ্রমিক মজনু মিয়া বলেন, ‘করোনার কারণে আমরা ক্ষতির মুখে পড়েছি। প্রতি মাসে আমরা আজ থেকে নয় হাজার টাকা ইনকাম করতাম, সেই পথটি বন্ধ হয়ে পড়েছে। সব চেয়ে বড় কথা হলো, আমরা কাজ করতে পারছি না। বেকার হয়ে পড়ে আছি। কেউ কোনো সহযোগিতা করছে না। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের আর্থিক অনুদান বরাদ্দ দেবেন।’
স্বপ্নচাষ/আরএস
বাংলাদেশ সময়: ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২৭ মে ২০২০
swapnochash24.com | Anaet Karim