কবি শেখ ফজলল করিম
চারদিকে যখন শুধুই অন্যায় আর অবিচার, শাসকের শোষণ আর মুনিবের নির্যাতনে মানুষ যখন অতিষ্ট, হতাশার মাঝে আশার প্রদীপের যখন নিভু নিভু অবস্থা। তৃষ্ণার্ত কাকের মত যখন মানুষ সামান্য শান্তির জন্য ছুটাছুটি করে, কিন্তু পায় না। নিরাশ মনে যখন ভাবে জন্মই তাদের সারাজীবনের জন্য এক অভিশাপ। ভাবে, পৃথিবীর কোথাও সুখ-শান্তি নাই, যদিও বা থাকে হয়তো তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ঠিক এমনি সময়ে গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্য সুখ ও শান্তির উৎস নিয়ে হাজির হন লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ থানার এক হাতুড়ে চিকিৎসক। তিনি জানিয়ে দেন- পৃথিবীতে সকল শান্তি-অশান্তির মহানায়ক মানুষই। মানুষের মাঝেই লুকায়িত আছে সকল সুুখ ও শান্তি। আবার মানুষই পারে এই পৃথিবীকে অশান্তির অনলে পরিণত করতে।
কাব্যিক ভাষায় তার উচ্চারণ- ‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর ? মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।’ তার এই কথায় পাল্টে মানুষের দর্শণ। খুঁজে পায় মানুষ নিজেকে, নিজের জীবনকে, সমাজ বাস্তবতাকে।
কিন্তু কে সেই হাতুড়ে চিকিৎসক? কি তার পরিচয়? আদৌ কি তিনি একজন হাতুড়ে চিকিৎসক? নাকি অন্যকিছু? না, তিনি কোনো হাতুড়ে চিকিৎসক নন। তিনি হলেন শতশত ক্রোশ ভ্রমণ করে জ্ঞান আরোহণের কবি, বাংলা সাহিত্যের প্রাণ ভোমরা, বাংলা ভাষার নিবেদিত প্রাণ- কবি ‘শেখ ফজলল করিম’।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকে তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু সাহিত্য চর্চা করে গেছেন আজীবন। সৃষ্টি করে গেছেন অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস, গল্প, জীবনী গ্রন্থ। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তার ‘সরল পদ্ম বিকাশ’ নামে একটি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
অসামন্য প্রতিভাবান এ কবির জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর’ ১৮৮২ সাল, ৩০ চৈত্র ১২৮৯ বঙ্গাব্দে লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা নামক স্থানে।
তাঁর পিতার নাম আমিরউল্লাহ সরদার এবং মাতার নাম কোকিলা বিবি। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ফজলল করিম ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর পারিবারিক ডাক নাম ছিল মোনা।
শেখ ফজলল করিমের শিক্ষা জীবন শুরু হয় পাঁচ বছর বয়সে কাকিনা স্কুল থেকে। সেখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি চলে যান রংপুরে। ভর্তি হন রংপুর জেলা স্কুলে। কিন্তু সেখানে তিনি লেখাপড়ায় মন বসাতে পারেননি। ফলে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত না করেই চলে আসেন তার গ্রামের বাড়িতে।
কিন্তু এখানেও তিনি লেখাপড়ায় মন বসাতে পারেননি। আবারো চলে যান রংপুর জেলা স্কুলে ১৮৯৯ সালে। কিন্তু এবারো তিনি পড়াশোনায় মন বসাতে ব্যর্থ হন। কবি গ্রামে ফিরে আসেন। এসময় তার বিয়ে হয়। কবির তখন বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। তার সহধর্মীনির নাম বসিরন নেসা। বিয়ের পরপরই তার লেখাপড়া সমাপ্ত হয়।
লেখাপড়া সমাপ্ত হলেও সমাপ্ত হয়নি সাহিত্য চর্চা। তিনি অসংখ্য বই সংগ্রহ করতেন, পড়তেন এবং অন্যকে পড়তে উৎসাহিত করতেন। সাহিত্য চর্চার সুবিধার্তে তিনি আহামদিয়া লাইব্রেরি নামে একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার তৈরি করেন।
সাহিত্য সৃষ্টি ও প্রকাশনার প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড আগ্রহ। এ থেকেই তিনি নিজ বাড়িতে ‘সাহাবিয়া প্রিন্টিং’ ওয়ার্কস নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইসলামরে ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে প্রেরণা লাভ করেন। ইসলামের সৌন্দয্য বোধ থেকেই তার মনে নীতিবাদ প্রভাব বিস্তার করে। মুসলিম জাতির ঐতিহ্যের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। তার লেখনীর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল আত্মবিস্মৃত মুসলমান জাতিকে তার লুপ্ত প্রায় ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করা। ধর্মীয় ইতিহাসে গল্পরে রস সঞ্জিন করে তিনি একদিকে যেমন সৃষ্টিকর্তার সন্তষ্টি লাভের চেষ্টা করেছেন, তেমনি জীবন্ত করে তুলেছেন সমাজ বাস্তবতাকে।
ইসলামের গৌরব ও অতীত ঐতিহ্য নিয়ে মুষ্টিমেয় যে কজন মুসলমান লেখক বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন তিনি তাদের মধ্যে একজন।
কবির চলার পথ সহজ ছিল না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। অসামান্য প্রতিবন্ধতার মধ্যেও তিনি ৪০টির মত বই রচনা করেছেন।
কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে, সরল পদ্য বিকাশ (১৮৯৩), তৃষ্ণা (১৯০০), পরিত্রাণ কাব্য (১৯০৪), ভক্তি পুষ্পাঞ্জলি (১৯১১), গাঁথা (১৯১৩) প্রভৃতি।
লায়লী মজনু (১৯০৪) শেখ ফজলল করিমের রচিত উপন্যাস। মানসিংহ (১৯০৩), মহর্ষি হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির (র) জীবন-চরিত (১৯১৪), চিন্তার চাষ (নীতিকথা, ১৯১৬), বিবি রহিমা (জীবনী, ১৯১৮), পথ ও পাথেয় (১৯১৮), রাজর্ষি ইব্রাহীম (জীবনী, ১৯২৫), বিবি খাদিজা (জীবনী, ১৯২৭), বিবি ফাতেমা (জীবনী, ১৯২৭) ইত্যাদি তার লিখিত প্রসিদ্ধ গদ্যগ্রন্থ। হারুন-অর-রশিদের গল্প (১৯১৬) ও সোনার বাতি (১৯১৮) তার শিশুতোষ গ্রন্থ।
সাহিত্য রচনার স্বীকৃতি স্বরুপ কবি অসংখ্য পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। কবি রোমিও-জুলিয়েট সম্পর্কিত একটি কবিতা পাঠ করে বাংলার শেক্সপিয়র আখ্যা পান। পথ ও পাথেয় গ্রন্থের জন্য তিনি রৌপ্যপদক লাভ করেন। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে নদীয়া সাহিত্য সভা তাকে সহিত্য বিশারদ উপাধিতে ভূষিত করে। চিন্তার চাষ গ্রন্থের জন্য তিনি নীতিভুষণ, কাশ্মীর শ্রীভারত ধর্ম মহামণ্ডল তাকে রৌপ্য পদকে ভূষিত করে।
এছাড়া তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাকে কাব্য ভাষণ, সাহিত্যরণ, বিদ্যাবিনোদ, কাব্যরন্তকার ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করে।
মানবতার এ মহান কবি ১৯৩৬ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবি নিজ গ্রামের বাড়ি কাকিনা নামক স্থানে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।
স্বপ্নচাষ/আরএস
বাংলাদেশ সময়: ১:১০ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ জুন ২০২০
swapnochash24.com | sopnochas24
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | |
৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ |
১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ |
২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ |
২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |